বিবিএ নিউজ.নেট | রবিবার, ০৩ জানুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট | 548 বার পঠিত
আমরা আশরাফ সিদ্দিকীর পাঁচ সন্তান তার নাতি-পুতিদের নিয়ে আমাদের গ্রাম নাগবাড়িতে এসেছি। তাকে ছাড়া গ্রামে কবে শেষ এসেছি মনে করতে পারলাম না। আমাদের মাইক্রোবাসটায় শুয়ে শুয়ে আসতেন তিনি। আর আমি উঠতাম ভাইবোনদের সঙ্গে অন্য গাড়িতে। এবার আর তার প্রয়োজন পড়ল না। কারণ এবার তিনি তো নেই। গাড়ি থেকে নামলাম। প্রাণ ভরে দেখলাম শস্য ফুলে সোনা ভরা মাঠ, সেই উঠান। সেই আম-লিচু আর বেল গাছ! সেই ঘর! সবই তো তেমন আছে। শুধু রেশমের মতো পাকা চুল উড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে, নার্স শেফালীর ঘাড়ে ভর দিয়ে আমার ৯৪ বছরের শিশুটি গাড়ি থেকে আর নামল না।
কিন্তু কি আশ্চর্য। আমি তো ঠিক শুনতে পারছি তার গলা। কই রে তোরা সব কই? আমি আইসা পড়ছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছেন, ‘হেড মাস্টার তুমি খবর পাইলা কই?’, ‘ওমা নতুন বাড়ির মজনু কাক্কাও দেখি।’ উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে না পেরে বাবা আবার বলছেন, ‘এইবার কি সুন্দর পানি আসছে, কাক্কা, ছোটবেলার মতন সাঁতার দিবা?’ ততক্ষণে চারপাশে ভিড় জমে গেছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে ভীষণ লম্বা গৃহকর্মীর উদ্দেশে বলছেন, ‘এই দশফুটি, ভটভটি (ইঞ্জিনের বড় নৌকা) ভাড়া হইছে তো? বিকেলে গ্রামের সক্কলরে নিয়া দুর্গা পূজা দেখবার যামু।’ খানিক বাদে আবার বলছেন, ‘ও হাসমতের বৌ, কী পিঠা বানাইছ? নাতি-পুতি নিয়া আইছি, আন্দেশা আর মুকশলা পিঠা বানাইছ তো? হাসমত বাদাম টানা আনছে তো?’
হ্যাঁ, আমি এ বছর ১৯ মার্চ আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়া ড. আশরাফ সিদ্দিকীর কথা বলছি। টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার এই নাগবাড়ি গ্রামেই তার জন্ম। এখানেই কেটেছে তার শিশুকাল। এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথকে কিছু গ্রাম্য ছড়া পাঠিয়ে পেয়েছিলেন তার জীবনের অমূল্য সম্পদ, রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে লেখা চিঠি। ক্লাস সেভেনে উঠে চলে যান ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে পড়তে। তারপর কলকাতা সিটি কলেজ, শান্তি নিকেতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সব শেষে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও পিএইচডি। মাস্টারি জীবন কেটেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে। কিন্তু তার সত্তা বাঁধা ছিল এই নাগবাড়ি গ্রামে। তাই তো তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তালসোনাপুরের ‘তালেব মাস্টার’-এর মতো কবিতা। পিএইচডির মাঝেই বিশ্বকে উপহার দিতে পেরেছিলেন মায়ের মুখে শোনা ‘ইযড়সনড়ষ উধংং ঃযব ঁহপষব ড়ভ ষরড়হং’-এর মতো শিশু সাহিত্য। ম্যাকমিলান প্রেস থেকে প্রকাশিত সে বই ১১টা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মা খালাদের মুখে মুখে চলে আসা লোককাহিনীকে দিতে পেরেছেন লিখিত রূপ। জেলা গেজেটিয়ারে নিষ্ঠার সাথে সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন প্রায় সব জেলার লোকগাথা। গড়ে তুলেছিলেন ফোকলোর সোসাইটি, জাতিকে উপহার দিয়েছেন বাংলা একাডেমি বইমেলা। নিজেও সম্মানিত হয়েছেন নানা পদকে ভূষণে—একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কারে।
ওই তো আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি আমগাছতলায় বসে নাতি-নাতনিদের শোনাচ্ছেন তার সাহিত্যিক হওয়ার গল্প। ‘ওই যে পার হয়ে এলে দক্ষিণ বাড়ি, ওটাই আমার নানা বাড়ি। সেখানেই আমার জন্ম। আমার নানা জমিদার এবাদত চৌধুরী ছিলেন সংস্কৃতিবান এক মানুষ। তার পানসী বোটের ছাদে কবির লড়াই হতো, পালাগান হতো। আমার আব্বা এই উঠানে সঙের নাটক আয়োজন করতেন। গ্রামবাসী সবাই এক সাথে রাতভর সেসব অনুষ্ঠান উপভোগ করত। বুঝলা নানা আর দাদা ভাইরা, আমার জীবনই আমার সাহিত্যের কাঁচামাল!’
আমি তো আরো ৪৮ বছর পেছনে চলে গেলাম। ড. আশরাফ সিদ্দিকী তার মায়ের চার দুয়ারি ঘরের জোড়া খাটে শুয়ে আছেন। পাশে বসে গল্প করছেন তার মা, বড় দুই বোন মালতি ও মতি। আর আমরা কচিকাঁচারা শুনছি। মালতি ফুপু বললেন, ‘আলম, তুমি কি দুষ্টই না ছিলা। মায়ের মুখে রাবণের লংকাকাণ্ডের গল্প শুইনা, তা ঘটানোর জন্য বিল্লির ল্যাজে দড়ি বাইন্ধা আগুন দিছিলা। বিড়াল আগুন নিভাইতে ঝাঁপ দিল পায়খানার পাগারে। তখন ছিল কনকনা শীত। শীতের চোটে ভিজা বিড়াল গিয়া ঢোকে বিয়াবাড়ির নাইওরিদের লেপের ভিতরে। আব্বা আইসা রাইগা বললেন, কোথায় আলম?’ ৩২ পাটি দাঁত বের করে বলছে, ‘আব্বা আমারে পাবো কই? আমি এক দৌড়ে চইলা গেছি নানির কাছে দক্ষিণ বাড়িতে।’ মতি ফুপু বলছেন, ‘তোগো বাবার গল্প শেষ করা যাবো না। মালতি আপা আলমরে গোসলের জন্য জবরদস্তি কইরা তার কাপড় খুলছিলেন। যেই না নিচু হইয়া বইসা প্যান্ট খুলছে ওমনি আলম তার চোখে মুখে প্রস্রাব কইরা দিল।’ এটা অবশ্য বাবা অস্বীকার করলেন। বললেন, ‘মতি বুজি, এটি বানায়া বললা।’ সে কি হাসির রোল।
বেশ কিছুদিন আগে গ্রামে গিয়ে বাবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি তার নাতিদের সঙের নাচ দেখাবেন বলে তাদের খবর পাঠালেন। সেই দলের একজন এসে জানাল তাদের দলটি ভেঙে গেছে। তারা অনুষ্ঠান করতে গেলে বোমা ফাটানোর ভয় দেখানো হয়েছে, তাই সঙের নাচ আর হয় না। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বাবা। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘হারিয়ে যাচ্ছে আমার সহস্র বছরের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য।’ একটু পরে নিজেকে গুছিয়ে বললেন, ‘নতুন প্রজন্মের টিভির অনুষ্ঠান পরিচালকদের বলব, হীরামন, মেঠোসুর, একতারা বলে বিটিভিতে যেসব গীতিনাট্য করতাম, সেগুলো আবার শুরু করুক।’ সত্যিই সত্তর ও আশির দশকে বাবার এ অনুষ্ঠানগুলো দারুণ জনপ্রিয় ছিল। আমরা চিনেছিলাম চাঁদ সওদাগরকে, চম্পাবতী আর গাজী কালুকে।
এবার আমরা পাঁচ ভাইবোন গ্রামে এসেছি পারিবারিক সম্পদ বণ্টনের জন্য। প্রায় ১০-১২ বছর আগেই জমির সব পরচাগুলো গুছিয়ে ফটোকপি করে তার ছেলেমেয়েকে দিয়ে গেছেন। একটাই অনুরোধ ছিল তার। মাগো কিছু কিন্তু বিক্রি করবে না। আমি কোনোদিন কিছু বেচিনি। উল্টেপাল্টে দেখলাম কত যত্নে নিজ হাতে লিখেছেন, ‘রেওয়াজ বদল’, ‘ক্রয় সূত্রে’, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ ইত্যাদি। সব ভাইবোন সমানভাগে বুঝে নিচ্ছি তার গাঁয়ের সম্পদ। একইভাবে বহন করতে পারব তো তার গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে লালন করার দায়িত্ব?
Posted ৪:৩৪ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৩ জানুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy